ব্যাংকিং ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যা মানুষের সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ঋণ এবং লেনদেন সহজ করে তোলে। বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি প্রধান ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে—ইসলামী ব্যাংকিং এবং সাধারণ বা প্রচলিত (conventional) ব্যাংকিং। এই দুটি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য, যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, অর্থনৈতিক কাঠামো, লভ্যাংশ এবং পরিচালনার ধরণে প্রতিফলিত হয়। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো ইসলামী ব্যাংক ও সাধারণ ব্যাংকের মূল পার্থক্য, সুবিধা ও অসুবিধাগুলো সম্পর্কে সহজ ভাষায়।
ইসলামী ব্যাংক ও সাধারণ ব্যাংকের মৌলিক পার্থক্য
ইসলামী ব্যাংকিং একটি শরিয়াভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা যেখানে সুদ (রিবা) গ্রহণ ও প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এই ব্যাংকগুলো ইসলামি শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত হয় এবং অর্থ বিনিয়োগে হারাম (নিষিদ্ধ) খাতে অর্থ ব্যয় করা যায় না। ইসলামী ব্যাংক লভ্যাংশ ভিত্তিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। এখানে মুনাফা অর্জন ও বন্টনের মূলনীতি হলো অংশীদারিত্ব (মুদারাবা), মুশারাকা বা ইজারা মডেলের মাধ্যমে বিনিয়োগ।
অন্যদিকে সাধারণ ব্যাংক হলো একটি সুদভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা মূলত নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে আমানতের বিপরীতে এবং ঋণের ক্ষেত্রে গ্রাহক থেকে সুদ আদায় করে। এ ধরনের ব্যাংক ব্যবসা, শিল্প, কৃষি কিংবা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করে এবং কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকে না। পরিচালনার ক্ষেত্রে এরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (বাংলাদেশ ব্যাংক) সাধারণ নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে।
ইসলামী ব্যাংকে কোনো “সেভিংস অ্যাকাউন্টে” সুদ দেওয়া হয় না, বরং গ্রাহক মুনাফায় অংশীদার হয়। অন্যদিকে সাধারণ ব্যাংকে সেভিংস বা ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। ইসলামী ব্যাংকে বোর্ডে শরিয়া পরামর্শক (Shariah Board) থাকে যারা প্রতিটি বিনিয়োগ ও কার্যক্রম শরিয়া সম্মত কিনা তা নিশ্চিত করে।
ইসলামী ব্যাংকের সুবিধা ও অসুবিধা
ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি শরিয়া ভিত্তিক এবং মুসলিম গ্রাহকদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বস্তি প্রদান করে। যেহেতু এখানে সুদ নেই, তাই এটি অর্থনৈতিক জুলুম থেকে মুক্ত থাকার একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিনিয়োগ হয় হালাল ও প্রকৃত ব্যবসায়িক খাতে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় সহায়তা করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হলো, ইসলামী ব্যাংক ঝুঁকি ও মুনাফা দুটোই ভাগ করে নেয়। ফলে ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে একটি পারস্পরিক বিশ্বাস ও অংশীদারিত্ব গড়ে ওঠে। এছাড়াও ইসলামী ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে—যেমন: যাকাত তহবিল পরিচালনা, ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা ইত্যাদি।
তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন: সব ধরনের সেবা এখানে সহজলভ্য নয়। আন্তর্জাতিক লেনদেন বা কার্ড সুবিধায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক ইসলামী ব্যাংকে। এছাড়া, গ্রাহকদের মধ্যে এখনও অনেকের শরিয়া ভিত্তিক বিনিয়োগ মডেল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কিছু ইসলামী ব্যাংকে মুনাফা বণ্টনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে থাকে।
সাধারণ ব্যাংকের সুবিধা ও অসুবিধা
সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি অত্যন্ত সহজলভ্য, দ্রুত কার্যসম্পাদনে সক্ষম এবং সকল শ্রেণির মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এখানে অ্যাকাউন্ট খোলা, ঋণ পাওয়া, অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড—সবকিছুই তুলনামূলকভাবে দ্রুত ও সহজলভ্য। একাধিক ব্যাংকের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে গ্রাহকরা বিভিন্ন স্কিম ও অফারের সুবিধাও পেয়ে থাকেন।
ব্যবসায়িক ঋণের ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাংকগুলোর ভূমিকা অনেক বেশি, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে গতি দেয়। বড় বড় প্রকল্প বা শিল্প স্থাপনের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায় সাধারণ ব্যাংক থেকে। এটি উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য সহায়ক।
তবে সাধারণ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হলো সুদ প্রথা। অনেক গ্রাহক এই সুদের কারণে আর্থিকভাবে চাপে পড়েন, বিশেষ করে যখন ঋণের সুদ হার বাড়ে। এছাড়া, অনেক সময় দেখা যায় যে, সুদ ভিত্তিক লেনদেন মানুষের আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির অভিযোগ কিছু কিছু সাধারণ ব্যাংকে নিয়মিত উঠতে দেখা যায়।
ইসলামী ব্যাংক ও সাধারণ ব্যাংক—দুটিরই রয়েছে নিজস্ব কার্যক্রম, দর্শন ও লক্ষ্য। ইসলামী ব্যাংক ধর্মভিত্তিক নৈতিকতাকে অগ্রাধিকার দেয়, আর সাধারণ ব্যাংক আধুনিক অর্থনীতির সহজ, দ্রুত ও সুদভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থা চালু রাখে। কেউ যদি শরিয়াসম্মত পন্থায় অর্থ সংরক্ষণ ও বিনিয়োগ করতে চান, তার জন্য ইসলামী ব্যাংক উত্তম। আর যিনি দ্রুত ও সুবিধাজনক ব্যাংকিং খুঁজছেন, তার জন্য সাধারণ ব্যাংক বেশি উপযোগী। তবে যেটিই বেছে নিন, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও গ্রাহকসেবা যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়—এই দিকগুলো যাচাই করেই ব্যাংক নির্বাচন করা শ্রেয়।