বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এক দশকে নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। মোবাইল ব্যাংকিং থেকে শুরু করে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, রিয়েল টাইম লেনদেন, লোন ম্যানেজমেন্ট—সবকিছুতেই এসেছে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা। তবে ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং নিয়ম পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়েছে, যার ফলে সাধারণ গ্রাহক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাইকে নতুন নিয়মে মানিয়ে চলতে হবে।
ব্যাংকিং নিয়মের এই পরিবর্তন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়, বরং সাইবার নিরাপত্তা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং গ্রাহকসেবার উন্নয়নের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। এই আর্টিকেলে বিস্তারিত জানবো নতুন নিয়মানুযায়ী কী কী পরিবর্তন এসেছে, কোন সেবা বা লেনদেনে সীমাবদ্ধতা বা সুবিধা যোগ হয়েছে এবং এগুলো আমাদের দৈনন্দিন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কেমন প্রভাব ফেলতে পারে।
যা যা থাকছে
একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য একত্রে সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, একজন গ্রাহকের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে সংযুক্তি বাধ্যতামূলক। এতে কেউ যদি একাধিক ব্যাংকে হিসাব খুলে থাকেন, সবগুলো তথ্য একটি জাতীয় তথ্যভিত্তিতে থাকবে।
এর ফলে—
-
কর ফাঁকি রোধ সহজ হবে
-
অনলাইন কেওয়াইসি (KYC) প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও নির্ভুল হবে
-
অপরাধমূলক আর্থিক কার্যক্রম চিহ্নিত করা সহজ হবে
ব্যাংকের দায়িত্ব হবে: গ্রাহকের এনআইডি ও মোবাইল নম্বর দিয়ে কেন্দ্রীয় সিস্টেমে অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা।
নগদ লেনদেন সীমা নির্ধারণ ও ইলেকট্রনিক লেনদেন উৎসাহিত
নগদ টাকার ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সাল থেকে নগদ উত্তোলন ও জমার সীমা নির্ধারণ করেছে।
-
দৈনিক ৫ লাখ টাকার বেশি নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত
-
১ লাখ টাকার বেশি জমা বা উত্তোলনে রশিদ ও পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক
-
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট গ্রহণের জন্য QR বা POS বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে
এ পদক্ষেপ ডিজিটাল লেনদেনকে প্রাধান্য দিচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
ডিজিটাল লোন আবেদন ও ডিসবার্সমেন্ট চালু
২০২৫ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লোন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রাহক ঘরে বসেই লোনের আবেদন, ডকুমেন্ট আপলোড এবং EMI প্ল্যান জানতে পারবে।
নতুন নির্দেশনায়:
-
এসএমই, কৃষি ও শিক্ষাঋণ প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতির আওতায়
-
ডিজিটাল লোনে লোন ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে
-
সর্বনিম্ন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লোন আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে
এতে ব্যাংকিং সময় বাঁচবে এবং দুর্নীতির সুযোগ কমবে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন সীমা ও নিরাপত্তা আপডেট
বাংলাদেশের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) যেমন: বিকাশ, নগদ, উপায়, রকেট—এসব প্ল্যাটফর্মেও এসেছে পরিবর্তন।
-
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ লেনদেন সীমা এখন ৫০,০০০ টাকা
-
লেনদেনের সময় বায়োমেট্রিক বা OTP ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক
-
নতুনভাবে লিমিটেড KYC ও ফুল KYC অ্যাকাউন্ট পৃথক করা হয়েছে
এই ব্যবস্থায় গ্রাহকরা আরও বেশি সুরক্ষিত থেকে টাকা পাঠাতে ও গ্রহণ করতে পারবে।
ব্যাংকে লেনদেন করতে হলে ডিজিটাল KYC বাধ্যতামূলক
২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকে ডিজিটাল KYC (Know Your Customer) বাধ্যতামূলক করেছে। এতে ব্যাংক খোলার সময় কাগজপত্রের ঝামেলা কমবে এবং গ্রাহকের নিরাপত্তা ও পরিচয় যাচাই সহজ হবে।
ডিজিটাল KYC’র মূল অংশ:
-
NID স্ক্যান করে সরাসরি তথ্য যাচাই
-
ফেস ভেরিফিকেশন বা লাইভ ছবি
-
অনলাইন ফর্ম পূরণ
-
ডেটাবেইজে তথ্য সংরক্ষণ
এতে একদিকে যেমন লেনদেনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে, অন্যদিকে ব্যাংকের কাগজপত্র সংরক্ষণের ব্যয়ও কমবে।
“ব্যাংকিং নিয়ম পরিবর্তন ২০২৫ – বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা” কেবল একগুচ্ছ নীতিমালা নয়, বরং এটি একটি নতুন যুগের সূচনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব আধুনিক পদক্ষেপ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের সহায়ক। যারা এখনো পুরনো নিয়মে অভ্যস্ত, তাদের দ্রুত নতুন নিয়ম অনুযায়ী খাপ খাওয়ানো প্রয়োজন। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই পরিবর্তন শুধু অর্থনীতির জন্যই নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও একটি বড় সুবিধা হয়ে উঠবে—বিশেষ করে নিরাপদ ও সহজ ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে।
