বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করে আসছে। আধুনিক ব্যাংকিং সেবা ও গ্রাহকবান্ধব নীতির মাধ্যমে এই ব্যাংক দেশব্যাপী বিস্তৃত একটি আর্থিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আর্থিক চাহিদা পূরণে পূবালী ব্যাংক চালু করেছে বিভিন্ন ধরণের ঋণ বা লোন সুবিধা। এ সকল ঋণ সুবিধা ব্যবসা, শিক্ষা, গৃহনির্মাণ এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনসহ নানা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক পূবালী ব্যাংকের জনপ্রিয় কিছু ঋণ সেবা সম্পর্কে।
যা যা থাকছে
পূবালী ব্যাংকের যাত্রা
পূবালী ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। তখন এর নাম ছিল “ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড” (Eastern Mercantile Bank Limited)। এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি ব্যবসায়ীদের নিজস্ব একটি ব্যাংক গড়ে তোলা, যাতে তারা সহজে ব্যাংকিং সুবিধা লাভ করতে পারেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের সঙ্গে সঙ্গে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কার্যক্রমও এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিকে সরকার জাতীয়করণ করে। এরপর ১৯৭২ সালের ২৪ মার্চ এর নতুন নামকরণ করা হয় “পূবালী ব্যাংক”। তখন এটি একটি জাতীয়করণকৃত ব্যাংক হিসেবে কাজ শুরু করে।
১৯৮৩ সালে সরকার পূবালী ব্যাংককে পুনরায় বেসরকারি খাতে স্থানান্তর করে, এবং ব্যাংকটির নাম হয় “পূবালী ব্যাংক লিমিটেড”। এই বেসরকারিকরণ ছিল ব্যাংকটির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি আরও স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায় এবং গ্রাহকসেবায় গুণগত পরিবর্তন আনে।
আধুনিকায়নের ধারায় পূবালী ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এটিএম, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন লোন আবেদনসহ আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা চালু করে। দেশজুড়ে এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয় — যার আওতায় বর্তমানে ৪৯১টিরও বেশি শাখা, ৯টি ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা এবং অসংখ্য এটিএম বুথ রয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের বিভিন্ন লোন সূমহ
একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের মধ্যে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড একটি সুপরিচিত নাম। ১৯৫৯ সালে যাত্রা শুরু করে পূবালী ব্যাংক আজ দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে এই ব্যাংকটি। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে পূবালী ব্যাংক চালু করেছে বিভিন্ন ধরনের ঋণ বা লোন সেবা। এ রচনায় আমরা পূবালী ব্যাংকের বিভিন্ন লোন সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
ব্যক্তিগত ঋণ (Personal Loan)
এই ঋণটি মূলত ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাতে সহায়ক। চাকরিজীবী, পেশাজীবী বা ব্যবসায়ী – যেকোনো ব্যক্তি এই ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন।
বৈশিষ্ট্য:
-
চিকিৎসা, শিক্ষা, বিয়ে, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতে ব্যবহারযোগ্য
-
সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন
-
সহজ কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য (১-৫ বছর মেয়াদে)
-
আয়ের নিশ্চয়তা থাকলেই আবেদন করা যায়
এই লোন গ্রহণে কোনো বড় জামানতের প্রয়োজন হয় না। তাই এটি সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক।
গৃহঋণ (Home Loan)
নিজের বাড়ির স্বপ্ন পূরণে পূবালী ব্যাংকের গৃহঋণ একটি কার্যকর সমাধান। এই ঋণের মাধ্যমে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা, নির্মাণ বা সংস্কারের কাজ করা যায়।
বৈশিষ্ট্য:
-
সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা
-
১৫-২০ বছর পর্যন্ত সহজ কিস্তিতে পরিশোধ
-
জমি বা ফ্ল্যাটের মালিকানার কাগজপত্র প্রয়োজন
-
প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার
এই ঋণ সাধারণত স্থায়ী চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও অভিবাসীদের জন্য উপযুক্ত। অনেক সময় প্রকল্পভিত্তিক গৃহঋণেও ছাড় পাওয়া যায়।
গাড়ি ঋণ (Car Loan)
ব্যক্তিগত বা অফিসিয়াল প্রয়োজনে গাড়ি কেনার জন্য পূবালী ব্যাংক গাড়ি ঋণ প্রদান করে থাকে।
বৈশিষ্ট্য:
-
ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক গাড়ির জন্য প্রযোজ্য
-
সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন
-
৫-৭ বছর মেয়াদে কিস্তিতে পরিশোধ
-
গাড়ির কাগজ ও জামানতের ভিত্তিতে ঋণ মঞ্জুর
এই ঋণ চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের জন্য সহজে প্রাপ্তিযোগ্য।
শিক্ষাঋণ (Education Loan)
শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার খরচ মেটাতে পূবালী ব্যাংক শিক্ষাঋণ সুবিধা দিয়ে থাকে। দেশ-বিদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এটি বেশ সহায়ক।
বৈশিষ্ট্য:
-
টিউশন ফি, ভিসা খরচ, বাসস্থান ইত্যাদি কাভার করে
-
গ্রাহকের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে পরিমাণ নির্ধারিত হয়
-
ছাত্র/ছাত্রীর অভিভাবকের গ্যারান্টি প্রয়োজন
-
পড়াশোনা শেষে কিস্তি পরিশোধের ব্যবস্থা
এই ঋণ শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে বাস্তব সহায়তা করে।
এসএমই ঋণ (SME Loan)
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য পূবালী ব্যাংক এসএমই ঋণ চালু করেছে, যা দেশের উদ্যোক্তা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বৈশিষ্ট্য:
-
স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সুবিধা
-
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ছাড়
-
ব্যবসা সম্প্রসারণ, যন্ত্রপাতি কেনা, পুঁজি বৃদ্ধি ইত্যাদি কাজে ব্যবহারযোগ্য
-
২ থেকে ৫০ লক্ষ টাকার মধ্যে লোন সীমা
উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় ঋণ সুবিধা।
কৃষিঋণ (Agricultural Loan)
কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য পূবালী ব্যাংক কৃষিঋণ প্রদান করে থাকে। এটি ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদি কাজে সহায়ক।
বৈশিষ্ট্য:
-
স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান
-
কৃষকের মৌসুমি চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ
-
কৃষি উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ
পূবালী লোন নিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
-
পূর্ণাঙ্গভাবে পূরণকৃত লোন আবেদন ফর্ম
-
আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) অথবা পাসপোর্ট
-
২–৪ কপি পাসপোর্ট সাইজের সদ্য তোলা ছবি
-
বৈবাহিক অবস্থা অনুযায়ী বিবাহ সনদ/নিকাহনামা (যদি প্রযোজ্য হয়)
-
বৈধ আয়/চাকরি/ব্যবসা সংক্রান্ত প্রমাণপত্র
-
সাম্প্রতিক বেতন স্লিপ বা ইনকাম সার্টিফিকেট
-
নিয়োগপত্র/চাকরির প্রমাণপত্র (চাকরিজীবীদের জন্য)
-
ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স (ব্যবসায়ীদের জন্য)
-
ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট (সাধারণত সর্বশেষ ৬ মাসের)
-
টিআইএন সার্টিফিকেট (যদি থাকে)
-
জামিনদারের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও প্রয়োজনীয় তথ্য
-
গৃহঋণের ক্ষেত্রে জমি/ফ্ল্যাটের দলিল, খতিয়ান, নামজারি, নকশা অনুমোদন কপি
-
গাড়ি লোনের ক্ষেত্রে গাড়ির প্রোফর্মা ইনভয়েস/কোটেশন
-
শিক্ষাঋণের ক্ষেত্রে ভর্তি সনদ, খরচ বিবরণ ও অভিভাবকের ইনকাম প্রমাণ
-
অন্য যেকোনো কাগজ যা ব্যাংক প্রয়োজন মনে করলে (যেমন: ইউটিলিটি বিল, কর পরিশোধ সনদ ইত্যাদি)
পূবালী লোনের সুধের হার
-
ব্যক্তিগত ঋণ (Personal Loan): সাধারণত ১৩% বার্ষিক সুদহার প্রযোজ্য।
-
গৃহঋণ (Home Loan): সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৯% সরল সুদহার প্রযোজ্য।
-
গাড়ি ঋণ (Car Loan): সাধারণত ১৩% থেকে ১৪% সুদহার প্রযোজ্য।
-
শিক্ষাঋণ (Student Loan): সাধারণত ৮.৫% থেকে ১৩% সুদহার প্রযোজ্য।
-
এসএমই ঋণ (SME Loan): সাধারণত ১৪% সুদহার প্রযোজ্য।
-
ট্রান্সপোর্ট ঋণ (Transport Loan): সাধারণত ১৪% সুদহার প্রযোজ্য।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং সেক্টরে পূবালী ব্যাংক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বহুমুখী ঋণ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন, গৃহনির্মাণ অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণ – যেকোনো আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পূবালী ব্যাংকের ঋণ পণ্য হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান।
ব্যাংকটি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায়সংগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং প্রতিটি গ্রাহকের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে ঋণ অনুমোদন দেয়। আপনি যদি ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে চান, তাহলে পূবালী ব্যাংকের লোন সুবিধা আপনার জন্য হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।